Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

উপজেলার ঐতিহ্য

ছাগলনাইয়া উপজেলার পটভূমি

 

বর্তমান ছাগলনাইয়া কোন এক সময়ে হয়তো বৌদ্ব সভ্যতার অন্তর্গত ছিল। পরে উত্তরের পাহাড়ী স্রোতে, প্রাকৃতিক কারণে বা নদী ভাঙ্গনে সাগরে লীন হয়ে কালের বিবর্তনে আবার ধীরে ধীরে ভূমি খন্ড খন্ড রুপে জেগে উঠে। ছাগলনাইয়া ভেঙ্গে জেঠে ওঠা ভূমির কারনেই এখানে, নোয়াখালীর বা চট্রগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের মতো প্রাচীন কোনো স্থাপনার নিদর্শন নেই, যেমন আছে কুমিল্লার বা ত্রিপুরার। এই মাত্র কয়েকশ বছর আগেও পুরান রাণীর হাট (আসলে ঘাট) থেকে পশ্চিম ছাগলনাইয়া পর্যন্ত প্রায় ১৪/১৫ মাইল ব্যাপী নদীর প্রশস্ততা ছিল এবং এ অংশ পার হতে হত খেয়া নৌকা দিয়ে। ছাগলনাইয়া অনেক অংশ অনেক পূর্বেই জেগে উঠে বনজঙ্গলে ভরে যায়। পাহাড়ের নিকট খন্ড স্থান বলে তখন এলাকার নাম হয় খন্ডল। ছাগলনাইয়া নামকরণ হয় অনেক পরে ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে। সে নামকরণ রহস্যাবৃত্ত। সাগর থেকে ছাগল হবার কথা ভুল। নোয়াখালীর উপভাষায় এরকম প্রয়োগ নেই। বগুড়ার রামচন্দ্র চৌধুরী নবাব সরকারের কার্য উপলক্ষে বঙ্গীয় একাদশ শতাব্দীর (খ্রিষ্ঠীয় পঞ্চদশ শতাব্দী) প্রথম ভাগে ভুলুয়ায় (বর্তমানে নোয়াখালী) এসে বদল কোন নামক স্থানে বাস করতে থাকেন। তিনি পরে ত্রিপুরা মহারাজের উচ্চ রাজ কর্মচারী নিযুক্ত হন। কোনো এক সময়ে তাকে নিয়ে মহারাজ চন্দ্রনাথ তীর্থে যান। পথিমধ্যে খন্ডলের জঙ্গলপূর্ণ সমতল ভূমি দেখে মহারাজ তা আবাদ করে প্রজাপত্তনের জন্য রামচন্দ্রকে নির্দেশ দেন। তিনি অনেক জায়গার বনজঙ্গল পরিস্কার করে বিভিন্ন স্থান বিশেষ করে ভুলুয়া থেকে উল্লেখযোগ্য সংখক ব্রাক্ষণ ও কায়স্থ সহ বহুলোক এনে বসতি পত্তন করেন। পরে তিনি আরো অনেক জায়গা আবাদ করেন। কাঁর তিনপুত্র গজেন্দ্র নারায়ন, প্রেম নারায়ন ও শুভেন্দ্র নারায়ন ও পিতার পদাস্ক অনুসরণ করে প্রায় পুরো খন্ডলে বসতি গড়ে তোলেন ও অনেক স্থানে ব্রাক্ষণ, কায়স্থ ও ভদ্র লোক উপবিষ্ট করান। এভাবে রামচন্দ্র ও তাঁর পুত্রাদি কর্তৃক খন্ডলের অনেক জায়গা প্রজাপত্তন ও আবাদি হলে ত্রিপুরা মহারাজ তাঁদেরকে খন্ডলের ইজারাদার নিযুক্ত করেন। এভাবে খন্ডল তথা বর্তমান ছাগলনাইয়ায় মনুষ্য বসতি ও আবাদ শুরু হয়। শমসের গাজীর আবির্ভাবে এসব জমিদার ইজারাদারদের অবস্থান সস্কুচিত হয় ও ক্ষমতা হ্নাস পায়। ঠিক কোন সময় থেকে কি কারণে এ খন্ডল অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে সে সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। দেখা যায়, এখনকার চাঁদগাজী মসজিদ প্রাচীন ১৭১২-১৩ সালের। অথচ মুর্শিদাবাদের মুর্শিদকুখী খাঁ ১৭১৭ সালে বাংলার নবাব নিক্তুক্ত হন। সেই থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত বাংলার নবাবী আমল। খুব সম্ভব, এ সময়েই এখানে মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। নোয়াখালীর অন্যান্য এলাকার মতো কয়েক শ’ বছর আগেই খন্ডলও মুসলমান প্রধান এলাকায় পরিণত হয়। স্মর্তব্য শিলূয়ার শিল সংলগ্ন চৌধুরী বাড়ীর জামে মসজিদটি ১৮৩৪ সালের।

 

ভুমির ভাঙ্গা-গড়ার মতো খন্ডলে জনমানুষের ও নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। ধারানা করা হয় যে, প্রাচীন কালে পার্শ্ববর্তী কুমিল্লার ত্রিপুরা চট্রাগ্রামের মতো খন্ডল তথা ছাগলনইয়াও (তখন ত্রিপুরার অন্তর্গত) বৌদ্ব ধর্মাবলম্বী লোকের বসবাস ছিল। প্রধানতঃ শিলূয়ার শিলের আবিস্কার এই ধারনা প্রতিষ্ঠার প্রধান যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়। তবে একটি মাত্র নিদর্শন প্রাপ্তি দিয়ে কোন যুক্তি দাঁড় করানোও বিপজ্জনক। এমনও তো হতে পারে, স্থানান্তরের সময় এ শিলটি বা অন্য দু’ একটি নিদর্শন তৎকালীন নদীতে পড়ে যেতে পারে, যা পরবর্তী কালে মাটির সঙ্গে উপরে উছে আসে। নোয়াখালীর চরাঞ্চলে এরকম কিছু ‘বয়া’ মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে বা কাত হয়ে থাকতে দেখা গেছে। আবার এমনও হতে পারে, এ শিলা ও আরো দু’ একটি নিদর্শন উজান কে স্রোতের বেগে ভাটির দিকে গড়িয়ে এসেছে। ‘নোয়াখালীর ইতিহাসে’ লেখা হয়েছে, ‘খন্ডল পরগনার অন্তর্গত চম্পকনগর গ্রামে অতি প্রাচীন কালে মগ বা বৌদ্ব ধর্মাবলস্মী রাজার আবাস বাটী ছিল এরুপ প্রবাদ। এই অঞ্চলের মটুয়া, মোটবী, শিলুয়া, মোট বাদীয়া, মঘুয়া, রাজনগর প্রভূতি গ্রামে প্রাচীন বৌদ্ব কীর্তির ভগ্নাবশেষ দেখিলে বৌদ্ব প্রভাবের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।’ সম্প্রতি ছাগলনাইয়া সীমান্ত সংলগ্ন মিরসরাই উপজেলার জোরালগঞ্জের ভগবতীপুর গ্রামে পুকুর খননের সময় চার ফুট মার্টির নিচে ৭০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ব মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয় পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, মিরসরাই, সীতাকুন্ড এলাকা প্রাচীন কাল ককে অন্ততঃ দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ব ধর্মাবলম্বীদের অধীনে ছিল। ১১০০-১২০০ সালের দিকে বৌদ্ব রাজারা দুর্বল হয়ে পড়লে ভুলুয়া (বর্তমান নোয়াখারী) ও ত্রিপুরার হিন্দু রাজারা মাথা তুলে দাঁড়ান ও হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান এবং পরবর্তী কালে মৃসলমানরা আধিপত্য বিস্তার করে।

ভাষা

 

 

ভাষা:

বাংলাদেশ মোটামুটিভাবে একই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত জনপদ হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক রীতিনীতি প্রচলিত আছে, সে সংগে আঞ্চলিক কথ্য ভাষা ও উচ্চারণ ভঙ্গি রয়েছে।শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক সব ধরণের লোকের কথা বার্তায় আঞ্চলিক ভাষা ও উচ্চারণের একটা প্রবণতা থাকে।ফেনী তথা ছাগলনাইয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচুর আরবী, ফার্সী ও পশ্‌তু শব্দ প্রচলিত রয়েছে।এখানকার কথ্য ভাষায় এমন অনেক শব্দ প্রচলিত আছে যা বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের লোকেরা সহজে বুঝতে পারে না।স্থানীয় বহুল প্রচলিত কিছু কথ্য ভাষা হলো : হোলা (ছেলে), মাইয়া (মেয়ে), ছালন (পাক করা তরকারী), সুরবা (তরকারীর ঝোল), ঘরবা (মেহমান), হোঁয়া (শসা), হউর ( শ্বশুর), আঁই (আমি), তুঁই (তুমি), হেতে (সে), হুব (পূর্ব), হইর (পুকুর), হক্কানে (সামনে), ওঁচে (উপরে), এক্কেনা (একটু), কন্ডে (কোথায়), রাঁই (বিধবা), হেগুন (তাহারা), হইক (পাখি), কিল্লাই (কেন), বিছইন (হাত পাখা), বাইয়্যুন (বেগুন) ইত্যাদি। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত ছাগলনাইয়ার মানুষের মধ্যেনানা ধরণের আদি লোকাচার বা সংস্কার, শুভ-অশুভ বিশ্বাস এখনো প্রচলিত রয়েছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছাগলনাইয়ারমানুষের সামাজিক মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়েছে।

 

সংস্কৃতি

আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক- ভৌগোলিক বহুবিধ অনুষঙ্গের কারণে অঞ্চল ভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রুপ পরিলক্ষিত হয়।তাই একটি দেশের সামগ্রিক লোকসংস্কৃতি এবং একটি বিশেষঅঞ্চলের লোকসংস্কৃতিতেও অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।ছাগলনাইয়া উপজেলা প্রাচীন সমতল জনপদের একাংশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই উপজেলার লোকসংস্কৃতিতেও তার একটি পরিছন্ন রুপরেখাপরিলক্ষিত হয়। বহু ভাঙ্গা-গড়া, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের ছাগলনাইয়া যা এক সময় সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ জনপদ ছিল।এ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির প্রতি একটু ঘনিষ্ট হলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এ অঞ্চলের একটি সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতির পরিমন্ডল রয়েছে।লোকসংস্কৃতির একটি প্রধানতম শাখা লোকসাহিত্য। ছাগলনাইয়ার লোকসাহিত্য এ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটাসমৃদ্ধ এবং জীবনঘনিষ্ঠ; তা এ অঞ্চলের প্রবাদ-প্রবচন, আঞ্চলিক গান, ধাঁ-ধাঁ, ছড়া থেকে সহজেই অনুমান করা যায়।নিম্নের আলোচনায় এর স্বরুপ কিছুটা উম্মোচিত হবে।

প্রবচনের কথাই ধরা যাকঃ “মাইনষের কুডুম আইলে গেলে, গরুর কুডুম লেইলে হুঁইছলে” এ প্রবচনটি অর্থ হলো মানুষেরকুটুম্বিতা তথা আতিথেয়তা বুঝা যায় পরস্পরের আসা যাওয়ার মাধ্যমে আর গরুর তা বোঝা যায় লেহনের মাধ্যমে।এ প্রবচনের অর্থের সাথে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে ঐতিহ্যগতভাবেই আত্মীয়বৎসল তা বুঝতে বাকী থাকার কথা নয়। “ ঝি থাইকলে জামাইর আদর, ধান থাইকলে উডানের আদর ”- এ প্রবচনটির সরল অর্থ হচ্ছে কন্যার কারণেই মানুষ কন্যাজামাতাকে খাতির করে আর ধান প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রয়োজনীয়তা হেতুই মানুষ উঠানের যত্ন করে।

কিন্তু এসব প্রবচনের মূলে যে সুক্ষ্ম দার্শনিক দিক রয়েছে তা কি আমরা ভেবে দেখার অবকাশ পাই? “মাছ ধোঅন হিঁডা, গোস্ত দোঅন মিডা” এ প্রবচনের মধ্য দিয়ে নবীন কোন রাঁধুনীকে শেখানোর চেষ্টা করা হয় যে, রান্নার আগে মাছটা খুব ভালোভাবে ধুতে হয় এবং মাংসটা অপেক্ষাকৃত কম ধুতে হবে।সাধারণ গার্হস্থ্য শিক্ষা ছাড়াও এ প্রবচন এটাই প্রমাণ করে যে, এ অঞ্চলের মানুষ সুদীর্ঘ সময় ধরেই মাছ, মাংস খেয়ে অভ্যস্থ। “না হাইত্তে খায় হুঁনি, না হাইত্তে করে চুরি” এ প্রবচনের শিক্ষা হচ্ছে পারতপক্ষে মানুষঅসম্মানজনক কাজ করে না এবং সংরক্ষিত খাবার খায় না। মাছের সংকট বলেই মানুষ যেমন বাধ্য হয়েই শুটকি খায় তেমনিনিতান্ত বাধ্য হয় বলেই মানুষ চুরি করে। দার্শনিক এ শিক্ষার পাশাপাশি এ প্রবচনে চাটগাঁর মত শুটকি যে এ অঞ্চলেরনৈমিত্তিক খাবার নয় তাও কিন্তু বুঝতে কষ্ট হয় না। এমনি “ হৈল হোনা গজার হোনা, যার যার হোনা তার তার হোনা” এ প্রবচনে সন্তান বাৎসল্যের সাথেসাথে আত্মমুখী ভালোবাসার মজ্জাগত বোধটি সরলভাবেই বিধৃত হয়। শোল মাছ, গজার মাছ যেগুলি কিনা রাক্ষুসে মাছ, যারা অন্য মাছের পোনা অবলীলায় খেয়ে সাবাড় করে। কিন্তু তারা নিজ নিজ পোনাকেসোনা যেমন মূল্যবান ধাতু হিসেবে মানুষ আগলে রাখে তেমনি আগলে রাখে। উপরিউক্ত প্রবচন গুলোর মত হাজারো প্রবচনএখানকার লোকমুখে প্রতিনিয়তই ব্যবহৃত। শুধু আমরা তা মনোযোগী হয়ে আমলে নিইনি, নেইনা। আঞ্চলিক গানের ক্ষেত্রেযদি একটু দৃষ্টি রাখি তাহলে দেখা যাবে, প্রতিটি গানের মাঝেই এ অঞ্চলের নিজস্ব সত্তার প্রকাশ ঘটছে। আঞ্চলিক গানেরকথা বলছি এ কারণে যে, লোকগীতি বললে তা আমাদের উপজেলা-জেলা ছাড়িয়ে পুরো ভাটিঅঞ্চলকে যুক্ত করে ফেলে। তবে ভাটিয়ালীগানে যে এ উপজেলার-জেলার মৌলিকত্ব নেই তা নয়। ভাটিয়ালী গান-গীতির ভৌগোলিক সীমা অনেক বেশি প্রসারিত। কাজেই একটিছোট অঞ্চলের গানই বোধ হয় প্রাধান্য পাওয়া প্রয়োজন। এ অঞ্চলের আঞ্চলিক গান ও শ্লোক যা ছাগলনাইয়ার গ্রামে-গঞ্জেএখনো দারিদ্র পীড়িত অধিকার বঞ্চিত মানুষকে ক্ষণিকের আয়েসী-আড্ডায় বুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তামগ্ন করে কিংবা কিঞ্চিতবিনোদিত করে এগুলোও তারই প্রমাণ।

“আঁডে গুড় গুড়, ছাঁড়ে মাডি ছ চোক তিন হুগুডি” -এ ধাঁ-ধাঁ টির উত্তর হলো হাল বা লাঙ্গল চালানো।জীবনের প্রত্যাহিকতাকে রসসিক্ত উপস্হাপন করার ক্ষেত্রে আমাদের নিরক্ষর পুর্বসুরীরা যে মোটেই অদক্ষ ছিলেন না, এ ধাঁ-ধাঁ তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ। “আইষ্টে ঠেং হোল আঁডু, তার নাম রাম টাডু, মাছ ধইত্তে যায়রে টাড়ু, হুউনাত মেলি জাল, মাছ খায় চিরকাল” মাকড়শাকে নিয়ে রচিত এ ধাঁ-ধাঁ আট পা বিশিষ্ট এ জীবের জীবন সমীক্ষণে যে গভীর পর্যবেক্ষণেরপরিচয় ফুটে উঠে তাতে আমাদের পুর্বসুরীদের মেধার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবনতই হতে হয়। এরকম “ উডান ঠন ঠন হিঁড়াত বাড়ী, ধলা হিরিসতার হোন্দে দাঁড়ি ”। “ কেরে ভাই চৈতি রাঙ্গা, গাছের আগাত হৈল হো'নাবনের তোন্ বার অইল ভুতি, ভাত বেড়াই দিল মুতি ” যথাক্রমে- রসুন, খেজুর, লেবু।

ফল ফসল সংক্রান্ত ধাঁধা ছাড়াও প্রত্যাহিক জীবনের নানা উপকরণনিয়ে রয়েছে হাজারো বৃদ্ধিদীপ্ত মুখরোচক ধাঁধাঁ।এছাড়াও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেনিয়ে দেখা যায় শতশত ছড়া, পদ-পদ্য এমনি প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক একটি বিয়ের অনুষ্ঠানেব্যবহৃত ছড়া হচ্ছে-আচ্ছালামালাইকুম তালতোভাই, দুলা আইছে বিয়া কইত্তো আন্নেরা আইছেন কিল্লাই। উত্তরে-“ওআলাইকুম আচ্ছালাম অবা, দুলা আইছে বিয়া কইত্তো আন্ডা আইছি লোইগ্যা”। রয়েছে ছেলে ভুলানো ছড়া-“ঝিঁঅ ঝিঁঅ মাগো/ নেঁওলা খাইতাম গেলামগো/কাঁডা হুঁড়ি মইল্যাম গো/ কাঁডায় লইল শুলানী/ বুড়িয়ে দিল দুয়ানি “। এ সকল ছড়া থেকে এটা সহজেই বুঝা যায় যে, এ অঞ্চলের ঐতিহ্যগতভাবেই রসপ্রিয় এবং তাদের রসবোধ জীবনঘনিষ্ঠএবং একান্ত নিজেদেরই মত। আজকের আকাশসংস্কৃতির বদৌলতে আমরা বহু বিষয়েই বিস্তৃত হচ্ছি। যাত্রা, পালাগান এসবই আজ সেকেলে ও অনাধুনিক।কিন্তু সেল্যুলয়েডে বন্দী জীবনাংশের তুলনায় এ অঞ্চলেরনট-নটীদের নান্দনিক উপস্থাপনায় এখনো গ্রামে-গঞ্জেমানুষকে পুরোরাত জেগে যাত্রা-পালা শুনতে কম বেশি দেখা যায়বৈকি। লোক-সাহিত্যের কথা বাদ দিলেও এ অঞ্চলেরজনজীবনে যে ঐতিহ্য লালিত তার শিল্প বোধ ঈর্ষণীয় বলতে হবে। আপনিযদি নাগরিক সংস্কৃতির বলয় থেকে বেরিয়ে গ্রামে ঘুরেতে যান, আতিথ্য গ্রহণ করেন, আপনার দৃষ্টিতে গ্রাম্য কোন মানুষেরআতিথ্যে মুগ্ধ হবেনই।শুরু থেকে ফেরা পযন্ত আপনি পাবেন নানা ঐতিহ্যের স্বাক্ষর।দেখবেন আপনাকে বসার জন্য যে পাটি বাবিছানা দেয়া হয়েছে তাতে রয়েছে যত্নে বোনা কারুকর্ম। হয়তো তারইওপর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে একখানা চাদর; যাতে যত্নে করা সুঁচিশিল্প কিংবা এককোণে সুঁই সুতায় আঁকাবিচিত্র বনফুল আপনাকে আকৃষ্ট করবে। ক্ষণিকেরজন্য আপনি হয়তো ভাববেন বাহ্ বেশতো! আমাদের মায়েদের-মেয়েদেরঐতিহ্যগত শিল্পবোধ আপনাকে আলোড়িত করবে। হয়তোকেবল পাটালী গুড় আর শুকনো মুড়িই দেয়া হলো আপনাকেতাৎক্ষণিকভাবে; দেখবেন যে টুকরিতে বা সাজিতে যা দেয়া হবে তাতেরয়েছে নিপুণ কারুকাজ খঁচিত। ধাতব পানদানে কিংবা বেত, আঁতি, সুতো ইত্যাদি সমন্বয়ে বানানো পানদানে আপনাকে দেয়া হবে পান।দৃষ্টি থাকলে আপনি খুঁজে পাবেন আমাদের হাজারো বছরের লালিতঐতিহ্য। লাঙ্গল-জোয়াল, কোদাল-কাস্তে, টুকরি-সাজি, যেটারদিকেই তাকান না কেন আমাদের ঐতিহ্যগত শিল্পরসের একটি নমুনাআপনাকে আকৃষ্ট করবেই। উপরোক্ত বিষয়গুলো পযালোচনা করলে ইহাইপ্রতিয়মান হয় যে, আমাদের চারু ও কারুকলা দু'ই সংস্কৃতির পরিচয়দেয়। আর এ পরিচয়ের দিক থেকে আমাদের লোক ঐতিহ্যলোকসংস্কৃতি হাজারো বছরের

বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান

কিভাবে যাওয়া যায়:

যেভাবে যাওয়া যায়...

চাঁদগাজী ভূঁঞা মসজিদ

ফেনীর ছাগলনাইয়া থানার বিভিন্ন স্থানে বহু প্রাচীন কীর্তি বিদ্যমান। এসব প্রচীন কীর্তির মধ্যে মসজিদ, মন্দির, ইটের নির্মিত দালান, মাজার, দীঘি, রাস্তা, পাথর, প্রাচীন বৃক্ষ অন্যতম। মোঘল ও নবাবী আমলে নির্মিত এসব প্রাচীনকীর্তির পাশাপাশি ত্রিপুরার শাসক “ভাটির বাঘ” শমসের গাজীর সময়ে নির্মিত ও প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন স্থাপত্য কীর্তিও এএলাকার গৌরব হিসাবে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। ছাগলনাইয়া থানার চাঁদগাজী এলাকা মোগল আমলে বেশ উন্নত ছিল।এখানেই রয়েছে তিনশত বছরের পুরোনো চাঁদগাজী ভূঁঞা মসজিদ।চাঁদগাজী ভূঁঞা ছিলেন মোগল আমলে ফেনীর পূবর্অঞ্চলে এক স্বনামধন্য জমিদার। জানা যায়, আঠার শতকের গোড়ার দিকেতিনি প্রথম নদী ভাঙ্গনের কারণে প্রচুর ধন-সম্পদ ও লোকলস্করসহ দুরদেশ থেকে এসে বতর্মান ছাগলনাইয়ার মাটিয়াগোধাগ্রামে বসতি স্থাপন করেন।

 

সাত মন্দির

ছাগলনাইয়ায় ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন হিসেবে সাত মন্দির ঘোষণা করছে নিজের অস্তিত্ব।ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার পশ্চিম ছাগলনাইয়া গ্রামে এটি অবস্থিত। নিজ চোখে না দেখলে উপলব্ধিকরা যাবেনা এর অপুর্ব সৌন্দর্য্য।ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি যখন সংকটময় মুহুর্ত অতিক্রম করছে। যখন ম্যার জন শোরের পর লর্ড মনিংটন অর্থ্যাৎলর্ড ওলেয়েসলী গভর্ণর জেনারেল হয়ে ভারতে আগমন করেন, ঠিক তখনই ফ্রান্সের সাথে ইংল্যান্ড এক মহাযুদ্ধে লিপ্ত হয়।নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দিগি¦জয় এবং তার ভারত বিজয়ের কল্পনায় ইংল্যান্ড সস্ত্রস্ত; ভারতের পেশোয়া, সিদ্ধিয়া, হোলকার ও নিজাম

 

বাংলার বীর শমসের গাজী

বৃটিশ শাসনের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে (তথা ভারত,পাকিস্তান, বাংলাদেশ) মুসলীম শাসকরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন।তাদের মধ্যে বাংলার বীর শমসের গাজী অন্যতম। তার জম্মস্থান ছিল ছগলনাইয়া (ফেনী) উপজেলার চম্পকনগরে। এই জম্মস্থানছিল বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পড়েছে। এখানে তার স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক সুরঙ্গ পথ, শমসের গাজী দিঘী, এবংতারই খনন করে তৈরী করা এক খোইল্লা দিঘীসহ প্রবেশ পথ, বসত ঘরের চিহ্ন হিসাবে পড়ে আছে। এটি ভারত ও বাংলাদেশসীমান্তবর্তী পাহাড়ে। শমসের গাজীর বসত ঘরের দঃ পূর্বে যে দিঘী রয়েছে তার নাম শমসের গাজী দিঘী। এই দিঘীতে তারস্ত্রী সহ গোসল করতেন। স্ত্রী ছিলেন পদা শীল। শমসের গাজী পর্দাকে পছন্দ করতেন । স্ত্রীর পর্দার জন্য এই সুরঙ্গপথটি তৈরি করেন। যাতে তার সৌন্দর্য্যরে প্রতি কারও দৃষ্টি না পড়ে। সে জন্য এ পথে দিঘীতে যাওয়া আসা করতেন।

 

শুভপুর ব্রীজ

 

ছাগলনাইয়ার প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের আরেকটি অন্যতম নিদর্শন ফেনী নদীর উপর নির্মিত শুভপুর ব্রীজ।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতির সাথে জড়িত এই ব্রীজটি থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধকরেছিল অনেক বীরযোদ্ধা। এর চার পাশে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।

ছাগলনাইয়া প্রকৃতির আরেক দর্শনীয় স্থান কৈয়ারা দিঘী। উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের দারোগার হাট বাজারের উত্তরেবিশাল এ দিঘী। এখানকার প্রচলিত এক প্রবাদেই সাক্ষ্য মিলে দিঘীর অবস্থা।

 

জগন্নাথ কালি মন্দির

 

শমসের গাজী তার বাল্যকালের লালন কর্তা জগন্নাথ সেনের স্মৃতিতে একটি মন্দির ও কালি মূর্তি নির্মাণ করেন।মূর্তিটি ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর বাসস্ট্যান্ড’র পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত। জগন্নাথ মূর্তির দর্শনীয় বিষয় হচ্ছে, এর দুইনেত্র প্রকোষ্ঠে বসানো লাল বর্ণের পাথর। অন্ধকারে পাথরগুলো আলো বিকিরণ করে। প্রতিদিন দুর-দুরান্ত থেকেদর্শনার্থীরা এটি দেখতে আসে।

 

শিলুয়ার শীল

 

সাবেক রতননগর পরগনার একস্থানে উনিশ শতকের একটি শিলা দেখা যায়।এই শিলাটি প্রাচীন কীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম।এই শিলা থেকে ঐ স্থানের নামকরণ হয় শিলুয়া। এটি ছাগলনাইয়া হতে ৫-৬ মাইল পশ্চিমে কন্ট্রাক্টর মসজিদ বাজার হতেপ্রায় ৩ কিঃমিঃ দক্ষিণে মধ্যম শিলুয়া চৌধুরীবাজারের ৫০ গজ পশ্চিমে ও শিলুয়া চৌধুরী বাড়ীর পূর্ব পার্শ্বেছায়াসুনিবিড় স্থানে শীলটি অবস্থিত । ঐ স্থানটির চার পাশে লোহার পিলার ও কাটা তার দিয়ে ঘেরাও দেওয়া। এই স্থানেবৃক্ষরাজি ছায়াচ্ছন্ন স্থানে দর্শনার্থীদের বসার জন্য দুটি বেঞ্চ আছে। পাথরটি ত্রকটি টিন ও কাঠের চৌচালা ঘরদিয়ে আচ্ছাদিত।

অবস্থান:

শুভপুর, পাঠাননগর, মাটিয়াগোদা ও ছাগলনাইয়া

যোগাযোগ ব্যবস্থা

সড়ক পথ:- ফেনী থেকে সি এন জি যোগে ছাগলনাইয়া। আনুমানিক ভাড়া: সি এন জি (লোকাল) ২৫/-

                                       (প্রাইভেট) ১৪০/-

 

রেল পথ:- এই উপজেলায় কোন রেলযোগাযোগ নেই।

 

নৌ-পথ:- এই উপজেলায় কোন নৌ-যোগাযোগ নেই।

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

 

চাঁদগাজী ভূঁঞা

ফেনীর পূর্বাঙ্কলের একজন স্বনামধন্য জমিদার চাঁদগাজী ভূঁঞা। মোগল আমলে তার এ অঙ্কলে আগমন ঘটে। প্রথমে তিনি ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার দক্ষিণ পশ্চিমে ১৬৩৫ সালে আগমন করেন। পরবর্তী সময় নদীর ভাংগনের কারণে তার প্রচুর ধন সম্পদ এবং লোক লস্কর সহ কর্তমান মার্টিয়াগোদা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং মোগল সনদ প্রাপ্ত জমিদার রুপে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

তাঁর জমিদারী অঙ্কল ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের পাদদেশে এবং বর্তমান ফেনী জেলার পূর্বাঙ্কল। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর তৎকালীন ত্রিপুরা মহারাজ্য লক্ষণাদিত্য মানিক্য বাহাদুর কর্তৃক তাঁর জমিদারীর পতন ঘটে।

তিনি একজন ধর্মভীরু জনহিতৈষী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত চাঁদগাজী ভূঁঞা মসজিদ, চাঁদগাজী ভূঁঞা নামীয় বহু দীঘি এবং চাঁদগাজী বাজার ও চাঁদগাজী কাছারী বাড়ী কালের সাক্ষ্য হয়ে এখনও তার ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এই কালজয়ী মহাপুরুষকে ঘিরে পরবর্তীতে স্থাপিত হয়েছে চাঁদগাজী স্কুল, চাঁদগাজী কলেজ, চাঁদগাজী মাদ্রাসা, চাঁদগাজী ডাকঘর ও ইউনিয়ন পরিষদের কেন্দ্রস্থল।

তাঁর নির্মিত চাঁদগাজী ভূঁঞা মসজিদ মোগল স্থাপত্যের অনুকরণে এক অপূর্ব সৌধ মালা যা এখনও দর্শক পর্যটকদেরকে বিন্সিত করে। মসজিদের প্রধান দরজার শিরদেশে আছে এক কালো রঙের শিলালিপি। তাতে উৎকীর্ণ আছে ফার্সী ভাষার,‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ এবং তিনি ছন্দের কবিতা। প্রায় তিনশত বৎসর পূর্বে নির্মিত এই স্থাপত্যশিল্প রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। তাঁর সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছু জানা যায়না ।

কৈয়ারা বিবি

ভাটির বাঘ শমসের গাজীর মাতা কৈয়ারা বিবি। বীরমাতাহিসাবে সমগ্র অঙ্কলে প্রশংসিত। গাজী মাতা কৈয়ারা বিবির নামে কৈয়ারা দীঘি খনন করা হয়। কৈয়ারা গ্রাম ও তাঁর স্মৃতিই বহন করছে। কৈয়ারা দীঘি অত্র এলাকার সর্বত্র বিশিষ্ঠতা লাভ করে। এ বিশাল দীঘি নির্মল ও সুস্বাদু পানির জন্য বিখ্যাত ।

শমসের গাজী

১৭০৭ সালের ৩ রা মার্চ সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বিশাল মোগল সাম্রাজ্য তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যুব্ধবিগ্রহ ও উশৃঙ্খলতার সুযোগে খন্ড বিখন্ড হতে থাকে।

 

রেজু মিঞা

বিগত শতকের আনুমানিক মাঝামাঝিতে অত্র থানার বাঁশপাড়ায় তাঁর জম্ম বলে অনুমান। তিনি ত্রিপুরা মহারাজার তহশিলদার ছিলেন। তিনি আধুনিক ফেনীর স্থপতি কবি নবীনচন্দ্র সেনের সহায়তায় ও পরামর্শে মুহুরী নদীর উপর কাঠের পুল তৈরী করে দিয়েছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। এতে তাঁর ব্যয় হয়েছিল ঐ সময়ে ৫০০ টাকা। বর্তমান রেজুমিঞা পুল, রেজিুমিঞা বাজার তাঁরই গৌরবময় স্মৃতি বহন করছে। বাঁশপাড়া তহশিলদার বাড়ী তাঁরই বসতভিটা। তিনি প্রায় নববই বছর সাফল্যের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করে বর্তমান শতকের চল্লিশের দশকে মৃত্যুবরণ করেন বলে জানা যায়। ত্রিপুরা মহারাজার তহশিলদার রুপে তিনি এলাকার বহু উন্নয়ন মূলক কর্মে নিয়োজিত ছিলেন।