বর্তমান ছাগলনাইয়া কোন এক সময়ে হয়তো বৌদ্ব সভ্যতার অন্তর্গত ছিল। পরে উত্তরের পাহাড়ী স্রোতে, প্রাকৃতিক কারণে বা নদী ভাঙ্গনে সাগরে লীন হয়ে কালের বিবর্তনে আবার ধীরে ধীরে ভূমি খন্ড খন্ড রুপে জেগে উঠে। ছাগলনাইয়া ভেঙ্গে জেঠে ওঠা ভূমির কারনেই এখানে, নোয়াখালীর বা চট্রগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের মতো প্রাচীন কোনো স্থাপনার নিদর্শন নেই, যেমন আছে কুমিল্লার বা ত্রিপুরার। এই মাত্র কয়েকশ বছর আগেও পুরান রাণীর হাট (আসলে ঘাট) থেকে পশ্চিম ছাগলনাইয়া পর্যন্ত প্রায় ১৪/১৫ মাইল ব্যাপী নদীর প্রশস্ততা ছিল এবং এ অংশ পার হতে হত খেয়া নৌকা দিয়ে। ছাগলনাইয়া অনেক অংশ অনেক পূর্বেই জেগে উঠে বনজঙ্গলে ভরে যায়। পাহাড়ের নিকট খন্ড স্থান বলে তখন এলাকার নাম হয় খন্ডল। ছাগলনাইয়া নামকরণ হয় অনেক পরে ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে। সে নামকরণ রহস্যাবৃত্ত। সাগর থেকে ছাগল হবার কথা ভুল। নোয়াখালীর উপভাষায় এরকম প্রয়োগ নেই। বগুড়ার রামচন্দ্র চৌধুরী নবাব সরকারের কার্য উপলক্ষে বঙ্গীয় একাদশ শতাব্দীর (খ্রিষ্ঠীয় পঞ্চদশ শতাব্দী) প্রথম ভাগে ভুলুয়ায় (বর্তমানে নোয়াখালী) এসে বদল কোন নামক স্থানে বাস করতে থাকেন। তিনি পরে ত্রিপুরা মহারাজের উচ্চ রাজ কর্মচারী নিযুক্ত হন। কোনো এক সময়ে তাকে নিয়ে মহারাজ চন্দ্রনাথ তীর্থে যান। পথিমধ্যে খন্ডলের জঙ্গলপূর্ণ সমতল ভূমি দেখে মহারাজ তা আবাদ করে প্রজাপত্তনের জন্য রামচন্দ্রকে নির্দেশ দেন। তিনি অনেক জায়গার বনজঙ্গল পরিস্কার করে বিভিন্ন স্থান বিশেষ করে ভুলুয়া থেকে উল্লেখযোগ্য সংখক ব্রাক্ষণ ও কায়স্থ সহ বহুলোক এনে বসতি পত্তন করেন। পরে তিনি আরো অনেক জায়গা আবাদ করেন। কাঁর তিনপুত্র গজেন্দ্র নারায়ন, প্রেম নারায়ন ও শুভেন্দ্র নারায়ন ও পিতার পদাস্ক অনুসরণ করে প্রায় পুরো খন্ডলে বসতি গড়ে তোলেন ও অনেক স্থানে ব্রাক্ষণ, কায়স্থ ও ভদ্র লোক উপবিষ্ট করান। এভাবে রামচন্দ্র ও তাঁর পুত্রাদি কর্তৃক খন্ডলের অনেক জায়গা প্রজাপত্তন ও আবাদি হলে ত্রিপুরা মহারাজ তাঁদেরকে খন্ডলের ইজারাদার নিযুক্ত করেন। এভাবে খন্ডল তথা বর্তমান ছাগলনাইয়ায় মনুষ্য বসতি ও আবাদ শুরু হয়। শমসের গাজীর আবির্ভাবে এসব জমিদার ইজারাদারদের অবস্থান সস্কুচিত হয় ও ক্ষমতা হ্নাস পায়। ঠিক কোন সময় থেকে কি কারণে এ খন্ডল অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে সে সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। দেখা যায়, এখনকার চাঁদগাজী মসজিদ প্রাচীন ১৭১২-১৩ সালের। অথচ মুর্শিদাবাদের মুর্শিদকুখী খাঁ ১৭১৭ সালে বাংলার নবাব নিক্তুক্ত হন। সেই থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত বাংলার নবাবী আমল। খুব সম্ভব, এ সময়েই এখানে মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। নোয়াখালীর অন্যান্য এলাকার মতো কয়েক শ’ বছর আগেই খন্ডলও মুসলমান প্রধান এলাকায় পরিণত হয়। স্মর্তব্য শিলূয়ার শিল সংলগ্ন চৌধুরী বাড়ীর জামে মসজিদটি ১৮৩৪ সালের।
ভুমির ভাঙ্গা-গড়ার মতো খন্ডলে জনমানুষের ও নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। ধারানা করা হয় যে, প্রাচীন কালে পার্শ্ববর্তী কুমিল্লার ত্রিপুরা চট্রাগ্রামের মতো খন্ডল তথা ছাগলনইয়াও (তখন ত্রিপুরার অন্তর্গত) বৌদ্ব ধর্মাবলম্বী লোকের বসবাস ছিল। প্রধানতঃ শিলূয়ার শিলের আবিস্কার এই ধারনা প্রতিষ্ঠার প্রধান যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়। তবে একটি মাত্র নিদর্শন প্রাপ্তি দিয়ে কোন যুক্তি দাঁড় করানোও বিপজ্জনক। এমনও তো হতে পারে, স্থানান্তরের সময় এ শিলটি বা অন্য দু’ একটি নিদর্শন তৎকালীন নদীতে পড়ে যেতে পারে, যা পরবর্তী কালে মাটির সঙ্গে উপরে উছে আসে। নোয়াখালীর চরাঞ্চলে এরকম কিছু ‘বয়া’ মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে বা কাত হয়ে থাকতে দেখা গেছে। আবার এমনও হতে পারে, এ শিলা ও আরো দু’ একটি নিদর্শন উজান কে স্রোতের বেগে ভাটির দিকে গড়িয়ে এসেছে। ‘নোয়াখালীর ইতিহাসে’ লেখা হয়েছে, ‘খন্ডল পরগনার অন্তর্গত চম্পকনগর গ্রামে অতি প্রাচীন কালে মগ বা বৌদ্ব ধর্মাবলস্মী রাজার আবাস বাটী ছিল এরুপ প্রবাদ। এই অঞ্চলের মটুয়া, মোটবী, শিলুয়া, মোট বাদীয়া, মঘুয়া, রাজনগর প্রভূতি গ্রামে প্রাচীন বৌদ্ব কীর্তির ভগ্নাবশেষ দেখিলে বৌদ্ব প্রভাবের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।’ সম্প্রতি ছাগলনাইয়া সীমান্ত সংলগ্ন মিরসরাই উপজেলার জোরালগঞ্জের ভগবতীপুর গ্রামে পুকুর খননের সময় চার ফুট মার্টির নিচে ৭০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ব মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয় পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, মিরসরাই, সীতাকুন্ড এলাকা প্রাচীন কাল ককে অন্ততঃ দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ব ধর্মাবলম্বীদের অধীনে ছিল। ১১০০-১২০০ সালের দিকে বৌদ্ব রাজারা দুর্বল হয়ে পড়লে ভুলুয়া (বর্তমান নোয়াখারী) ও ত্রিপুরার হিন্দু রাজারা মাথা তুলে দাঁড়ান ও হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান এবং পরবর্তী কালে মৃসলমানরা আধিপত্য বিস্তার করে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS